Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

জুলুমের নির্মম পরিণতি (শিক্ষণীয় গল্প)

জুলুমের নির্মম পরিণতি (শিক্ষণীয় গল্প)



জুলুমের নির্মম পরিণতি

বনী ইস্রাঈলের এক ব্যক্তি। সমুদ্র তীরে তার বসবাস । একদিন সে কি এক প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হল। সমুদ্রের বিশাল জলরাশির পাশ দিয়ে একটু দ্রুত পদেই হাটছিল সে। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। কিন্তু হঠাৎ এক ব্যক্তির চিৎকার শুনে সে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হল । লোকটি উচ্চ আওয়াজে বলছিল-

হে লোক সকল, খবরদার! মানুষের উপর জুলুম করো না । আমাকে দেখে শিক্ষা গ্রহণ কর । জুলুমের শাস্তি কত নির্মম! কত নিষ্ঠুর আমার প্রতি লক্ষ্য করে তোমরা তা বুঝতে চেষ্টা কর ।

কথাগুলো শুনে লোকটির মনে কৌতুহল জাগল। সে তার নিকট এগিয়ে গিয়ে বলল, ভাই! কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন? জবাবে সে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে একটু জোড় গলায় বলল, কিছুই হয়নি আমার। এটা আমার প্রাপ্য। পাপের ফসল। জুলুমের নির্মম পরিণতি ।


: ভাই! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। অনুগ্রহ করে বিষয়টা একটু খুলে বলুন ।


: তুমি শুনবে? শুনতে চাও আমার অতীত জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী?


: হ্যাঁ, আপনি বললে অবশ্যই শুনব ।


এবার লোকটার উদাস হৃদয় থেকে বেরিয়ে এল আরেকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস। গন্ডদেশ সিক্ত করে প্রবাহিত হল উপচানো অশ্রুধারা। বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আঁচলে চোখ মুছে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল-


: তাহলে বস। আমি এক্ষুনিই আমার বিগত জীবনের করুণ কাহিনী তোমাকে শুনাব । একথা বলে সে শুরু করল-


আমি ছিলাম একজন সিপাহী। সমুদ্রের তীরে হেটে হেটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভোগ করা ছিল আমার প্রিয় সখগুলোর একটি। কঠিন ব্যস্ততাও আমাকে এ থেকে বিরত রাখতে পারত না। কোনদিন সকাল বিকাল দু’বার সম্ভব না হলেও একবার তো অবশ্যই যেতাম। বিশাল জলরাশির পর্বতসম উর্মীমালা দেখে দারুণ পুলকিত হতাম।


একদিনের ঘটনা ।


তখন ছিল সূর্যাস্তের সময়। বরাবরের মত সেদিনও আমি সমুদ্রের তীরে সূর্যাস্তের অলৌকিক শোভা দর্শন করছিলাম। সূর্য যখন একটা বড় থালার মত টকটকে লাল হয়ে ডুবতে শুরু করল তখন আমার মনে হল একটা রক্ত গোলাপ যেন ধীরে ধীরে সমুদ্রের মাঝখানে ডুবে যাচ্ছে। তার লাল কিরণচ্ছটাতে সমুদ্রের পানিও রক্তের মত লাল হয়ে গেছে। সে যে কি এক অপূর্ব দৃশ্য, তা যে দেখেছে, সে ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না ।


আমি সাগরের মাঝে সূর্যাস্তের মনমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন করে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি, একজন জেলে একটি বিশাল মাছ শিকার করেছে। তার চেহারা খুশিতে ঝলকিত। হৃদয় রাজ্যে প্রবাহিত হচ্ছে আনন্দের স্নিগ্ধ সমীর। আনন্দের হিল্লোল বয়ে চলছে গোটা দেহ জুড়ে ।


আমি ধীরে ধীরে তার নিকটে গেলাম। সোনালী রংয়ের বিশাল আকৃতির মাছটি প্রাণভরে দেখলাম। সত্যি কথা বলতে কি? এত সুন্দর বিরাট আকৃতির মাছ জীবনে কোন দিন দেখিনি। এক পর্যায়ে মাছটির প্রতি আমার লোভ এসে গেল । যে কোন উপায়ে উহাকে পাওয়ার জন্য হৃদয়মন ব্যাকুল হয়ে উঠল । সিদ্ধান্ত নিলাম, যেভাবেই হোক, এ মাছটি আমাকে পেতেই হবে । এ মাছ আমি চা-ই মাছটি যতই দেখছিলাম ততই আমার মনের মধ্যে উহাকে হস্তগত করার বাসনা তীব্রতর হচ্ছিল। কিছুতেই উহা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলাম না । তাই এক সময় লোকটির নিকট মনের কথাটি প্রকাশ করে বললাম, ভাই! তোমার এ মাছটি খুব পছন্দ হয়েছে আমার। তুমি উহা আমাকে দিয়ে দাও ।


জবাবে সে বলল- না, এ মাছ আমি কোন অবস্থাতেই দিব না ৷


আমি বললাম, কেন দিবে না? মাছটি যে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। যদি এমনিতে দিতে না চাও, তবে উপযুক্ত মূল্য দিয়েই আমি ক্রয় করতে চাই।


: উপযুক্ত মূল্য কেন, হাজার দিরহাম দিলেও আমি তা হাতছাড়া করব না ৷


: কেন? মাছটির প্রতি তোমার এত আগ্রহ কেন?


: আমি সারাদিন অনেক কষ্ট করে এ মাছটি শিকার করেছি। উপরন্ত আপনার নিকট উহা যেমন পছন্দের, তেমনি আমার নিকটও উহা বহুগুণে বেশী পছন্দের। আর কষ্ট করে অর্জিত পছন্দের জিনিষ কেউ হাতছাড়া করে কি?


: এসব আমি জানিনে। আমার পরিস্কার কথা হল, মাছটি আমার ভাল লেগেছে। সুতরাং যে কোন মূল্যে উহা আমি হস্তগত করবই ।


: জনাব! এ মাছের মালিক আমি। আমি না দিলে আপনি উহা কিভাবে নিবেন?


: আমি সিপাহী মানুষ। কিভাবে নিতে হবে তা আমার ভাল করেই জানা আছে । সুতরাং নিজের মঙ্গল চাইলে এখনই মনের খাহেশ ত্যাগ করে মাছটি আমার নিকট বিক্রি কর।


: আপনি সিপাহী মানুষ। তাই বলে দুর্বলের উপর অত্যাচার করা তো আপনার জন্য শোভা পায় না ।


: এত কথার প্রয়োজন নেই। যা বলেছি মানতে চেষ্টা কর। অন্যথায় মাছতো হারাবেই, পয়সাও পাবে না ।


: এটা কেমন কথা যে, আমার প্রিয় জিনিষটি আপনি জুলুম করে অন্যায়ভাবে নিয়ে যাবেন?


: আমি জুলুম-অত্যাচার বুঝি না। আমার অভিধানে অন্যায় বলতে কিছু নেই। আমি যা চাই, যা পছন্দ করি তা আমাকে পেতেই হবে । এটাই আমার ধর্ম ।


: জনাব! জুলুম করা ভাল নয়। এর পরিণতিও ভাল নয় । তা একটু ভেবে দেখেছেন কি?


: এত কিছু ভেবে দেখার সময় আমার নেই। আর মন্দ পরিণতির কথা বলছ? এ সবকে কখনই আমি পরওয়া করি না।


: জনাব! একি বলছেন আপনি? একজন বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে এমন কথা কি সাজে?


: দেখ, আমার ধৈর্যের বাধ কিন্তু ভেঙ্গে যাচ্ছে। তোমার মত একজন সাধারণ ব্যক্তির সাথে এত কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই । : তাহলে আপনি কি করতে চান?


: এই দেখ কি করতে চাই ।


এ কথা বলে তার নিকট থেকে আমি জোরপূর্বক মাছটি ছিনিয়ে নিয়ে বাড়ীর পথে রওয়ানা দেই। জেলেটি অনেক অনুনয়-বিননয় করে কেঁদে কেঁদে মাছটি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আবেদন করছিল । কিন্তু তার কোন কথাই আমার মনে ভাবান্তর সৃষ্টি করেনি। শত অনুরোধের পরেও মাছটি ফিরিয়ে দেইনি। অবশেষে সে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শুধু এতটুকু বলে চলে গেল যে, “হে রাহমানুর রাহীম! আমি দুৰ্বল, অসহায় । তোমার এক সবল বান্দা আমার উপর কত বড় জুলুম করেছে তা তুমি ভাল করেই দেখেছ। হে খোদা! তুমি আমাকে এবং এ সিপাহীকে বানিয়েছ। আমার তুলনায় তাকে শক্তিশালী করেছ। কিন্তু সে ঐ শক্তির সদ্ব্যবহার করেনি। হে পরওয়ার দিগার! সে আমার উপর নির্মম অত্যাচার করেছে। তুমি এ জুলুমের এমন বিচার কর যেন উহা থেকে সকলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে ।


তার প্রার্থনায় আমি মোটেও ভীত হইনি। জুলুমের পরিণতির কথা একবারও চিন্তা করিনি । বরং উল্টো রাগে আগুন হয়ে আমার চক্ষুদ্বয় টকটকে লাল হয়ে গেল। একজন সাধারণ জেলে, আমার কথা কেন মানল না, এজন্য দুঃখে-অপমানে আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল । তাই হঠাৎ আঘাত খাওয়া বাঘের ন্যায় গর্জন করে বললাম-


এই খবীস! ভাগ্‌ এখান থেকে ।


সে বলল- না, আমার মাছ না নিয়ে যাব না ।


যাবি না?


এতটুকু বলেই তার মাথায় প্রচন্ড জোরে আঘাত করলাম । আমার আঘাতের প্রচন্ডতায় সে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অতঃপর একটি বিকট চিৎকার করে জ্ঞান হারাল ।


লোকটি জমিনে পড়ে আছে। আশে পাশে কোন লোকজনও নেই । এ মুহূর্তে লোকটির জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করা আমার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেদিন আমি এতই নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিলাম যে, তার প্রতি আমার সামান্যতম সহানুভূতিও সৃষ্টি হল না। বিন্দুমাত্র মানবতাবোধও জাগ্রত হল না। তাই আমি সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে, তাকে একাকী ফেলে রেখে আবার বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলাম ।


বেশীদূর যাওয়া হল না আমার। শুরু হল জুলুম-অত্যাচারের ভয়ংকর শাস্তি । অন্যায়-অবিচারের নির্মম পরিণতি আমি মাছটি হাতে নিয়ে দ্রুত বেগে হাটছি। কিন্তু খোদার কি কুদরত! কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর মাছটি আমার আঙ্গুল কামড়ে ধরল । ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে গেলাম। হাত ছাড়ানোর জন্য বারবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হল না। পরে ঐ অবস্থাতেই বাড়ীতে এলাম। ঘটনা শুনে আশে পাশের অসংখ্য লোক সমবেত হল । অবশেষে বহু চেষ্টা তদবিরের পর বাড়ীর সকলে মিলে সেই মাছের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করতে সমর্থ হল ।


আঙ্গুল কামড়ে ধরার কারণে শুরু থেকে আমি প্রচন্ড ব্যথায় অস্থির ছিলাম । আঙ্গুল ছাড়ানোর পর ব্যথার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেল । অসহ্য যন্ত্রণায় আমি ছটফট করতে লাগলাম। অবশেষে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার আঙ্গুল পরীক্ষা করে বললেন, এই আঙ্গুল কেটে ফেলতে হবে। অন্যথায় উহার পচন দেহের সর্বত্র সংক্রমিত হয়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে ।


ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আঙ্গুল কাটা হল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যাধি হাতের তালুতে চলে এল । এবারও ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তালু পর্যন্ত হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিল ।


ডাক্তারের নির্দেশ সঙ্গে সঙ্গে পালন করা হল । কিন্তু হাতের তালু কেটে ফেলার পর সেই ব্যাধি হাতের কব্জিতে দেখা দিল ।


বর্ণনাকারী বলেন, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এভাবে আমি আমার হাত বারবার কাটাতে থাকলাম। আর ঐ মারাত্মক ব্যাধিটি আমার দেহের অভ্যন্তরের দিকে অগ্রসর হতে থাকল। এক পর্যায়ে আমার মনে ভয় ঢুকে গেল। আমি বাড়ীঘর, লোকালয় ত্যাগ করে জঙ্গলে পালিয়ে গেলাম ।


একদিন আমি জঙ্গল থেকে বের হয়ে মরুভূমিতে এলাম। প্রচন্ড ব্যাথায় তখন আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। কিন্তু আমার চিৎকার শুনার মত কোন লোক সেখানে ছিল না। এক সময় একটি গাছের ছায়ায় বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর একটু আরাম অনুভূত হলে আমি সেখানেই ঘুমিয়ে গেলাম। সেই ঘুমে আমি স্বপ্নে দেখলাম, এক ব্যক্তি আমাকে বলছে, ‘হে অমুক! এভাবে একের পর এক তোমার দেহের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে ফেললেও এই কঠিন মসীবত থেকে তুমি উদ্ধার পাবে না। স্মরণ কর, তুমি একদিন এক দূর্বল অসহায় জেলের মাছ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছিলে। এটা হলো তোমার সেই জুলুমের শাস্তি। মনে রেখ, যতদিন পর্যন্ত তুমি তার হক ফিরিয়ে না দিবে ততদিন তুমি এ আযাব থেকে কিছুতেই মুক্তি পাবে না ।


উপরোক্ত স্বপ্ন দেখার পর আমি আর বিলম্ব করলাম না । সাথে সাথে ঐ জেলের খোঁজে সমুদ্রের তীরে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, সেই মৎস শিকারী সমুদ্রে জাল ফেলে বসে আছে । আমি অদূরে দাঁড়িয়ে তার জাল টানার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর সে জাল টানল । দেখা গেল জালে প্রচুর মাছ আটকা পড়েছে। সে মাছগুলো খাচায় পুরে অবসর হওয়ার পর আমি নিকটে গিয়ে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও ।


সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?


আমি বললাম, আমি সেই হতভাগা সিপাহী, যে একদিন তোমার মাথায় আঘাত করে তোমার প্রিয় ও পছন্দের মাছটি ছিনিয়ে নিয়েছিল । অতঃপর আমার হাতটি কাপড়ের নীচ থেকে বের করে বললাম, তোমার উপর জুলুম করার কারণে আল্লাহ আমাকে এ শাস্তি দিয়েছেন ।


হাতের বিভৎস দৃশ্য দেখা মাত্রই বিজলী আহতের ন্যায় লোকটি চমকে উঠল। অতঃপর ক্ষণকাল নিশ্চুপ থাকার পর উচ্চস্বরে বলল, এমন ভয়ানক অবস্থা থেকে আল্লাহপাক সকলকে হেফাযত করুন । আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম ।


তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে হাতের ক্ষতস্থান থেকে একটি পোকা বের হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সেই সঙ্গে যাবতীয় ব্যথা-বেদনা ও দূরীভূত হল ।


আমি সুস্থ হয়ে বাড়ীতে চলে আসতে চাইলে সে আমাকে বলল, দাঁড়ান, আমি আপনার উপর বড় বে-ইনসাফী করেছি। একটি মাছের জন্য বদদোয়া করেছি। যার ফলে আপনি দীর্ঘ যাতনা ভোগ করেছেন । সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেছেন । চিরদিনের জন্য একটি হাত হারিয়েছেন । আসল কথা হল, জুলুমের শাস্তি যে এত কঠিন হয় এবং এত তাড়াতাড়ি আসে তা আগে আমার জানা ছিল না। যদি জানতাম, আপনি এত মারাত্মক ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সম্মুখীন হবেন, তবে কখনোই আমি বদদোয়া করতাম না। যা হোক, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এবার আপনি আমার সাথে বাড়ীতে চলুন ।


এতটুকু বলে সে আমাকে হাত ধরে তার বাড়ীতে নিয়ে গেল । অতঃপর ঘরের এক কোনে গিয়ে ছেলেকে বলল, এখানে মাটি খুঁড়। সে মাটি খুঁড়ে সেখান থেকে একটি মাটির কলস বের করল। ঐ কলসে ত্রিশ হাজার দেরহাম ছিল। লোকটি উহা থেকে বিশ হাজার দেরহাম আমার হাতে দিয়ে বলল, দশ হাজার দেরহাম নিজের জন্য রেখে বাকীগুলো আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে বিলিয়ে দিবেন। এ কথা বলে সে আমাকে বিদায় করে দিল ।


প্রিয় পাঠক! জুলুমের শাস্তি কত ভয়ানক তা আমরা আলোচ্য ঘটনায় জানতে পারলাম । উপরন্ত পরকালের মর্মান্তিক শাস্তি তো আছেই । জুলুম ও জুলুমকারীর পরিণতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য স্থানে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, (সেদিন) জালেমদের জন্য কোন দরদী বন্ধু থাকবে না এবং এমন কোন সুপারিশকারীও হবে না যার কথা মেনে নেয়া হবে। (সূরা আল মুমিনুন :১৮ )


অন্য আয়াতে বলা হয়েছে জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী হবে না । (সূরা হজ্ব : ৭১) হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুলুম করে এক বিঘত পরিমাণ জমীন দখল করে নিল, (কিয়ামতের দিন আল্লাহপাক) তার গলায় সাত তবক জমীন পড়িয়ে দিবেন। (বুখারী, মুসলিম)


অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি কোন ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের উপর মান-সম্মান বা অন্য কোন বিষয়ে জুলুম করে, তবে সে যেন ঐদিন আসার পূর্বেই তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেয় যেদিন তার নিকট দিনার বা দিরহাম কিছুই থাকবে না। অন্যথায় (কিয়ামতের দিন) তার জুলুমের সমপরিমাণ নেকী তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হবে। যদি তার কোন নেকী না থাকে তবে মজলুম ব্যক্তির গোনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে (বুখারী)


হযরত হোযাইফা (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা এরূপ বল না যে, লোকেরা ভাল ব্যবহার করলে আমরাও ভাল ব্যবহার করব । আর তারা জুলুম করলে আমরাও জুলুম করব । বরং তোমরা এরূপ করতে অভ্যস্থ হও যে, যদি লোকেরা ভাল ব্যবহার করে তবে তোমরাও ভাল ব্যবহার করবে। আর যদি তারা মন্দ আচরণও করে, তবুও তোমরা জুলুম করবে না । (তিরমিযি)


মুসলিম শরীফে বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা কি জান, গরীব কে? সাহাবাগণ বললেন, আমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই তো গরীব যার টাকা-কড়ি ও অর্থ- সম্পদ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (প্রকৃত গরীব সে নয় বরং) আমার উম্মতের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী গরীব হবে, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত নিয়ে আসবে কিন্তু সাথে করে ঐসব লোকদেরকেও নিয়ে আসবে যাদেরকে সে গালি কিংবা মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারও মাল আত্মসাত করেছে, কারও রক্ত প্রবাহিত করেছে, কাউকে প্রহার করেছে। এসব হকদারকে তাদের হক তার নেক আমলের বিনিময়ে দেয়া হবে। এভাবে হক আদায় করতে করতে যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তবে তাদের গুনাহসমূহ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে । অতঃপর তাকে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে ।


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! উল্লেখিত আয়াত এবং হাদীসসমূহ প্রমাণ করে জুলুম-অত্যাচার ও অন্যায়ের পরিনতি কত মারাত্মক। নামায রোযা হজ্জ যাকাত ইত্যাদি নেক আমল ঠিকমত পালন করার পরেও শুধু অন্যায়ভাবে অপরের হক নষ্ট করার কারণে শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্থান জাহান্নামের অধিবাসী হতে হবে। সুতরাং আজ থেকেই আমরা প্রতিজ্ঞা করি, কারও উপর জুলুম করব না। কারও হক নষ্ট করব না । যদি অতীতে কারও হক নষ্ট করে থাকি তাহলে আজই তার নিকট হাজির হয়ে হক আদায় করে হোক কিংবা মাফ চেয়ে হোক- যে কোন উপায়ে উহা থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করি। তাহলেই দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের জন্য মুক্তির পথ সুগম হবে। চির শান্তির স্থান বেহেশতের অধিবাসী হয়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারব। আল্লাহ আমাদের তৌফিক নসীব করুন । আমীন। সুত্র: তাযকিরাতুল আউলিয়া।

Post a Comment

0 Comments